ডেস্ক রির্পোট:- দেশে নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। একেকটি নির্যাতনের ঘটনায় দেখা যায় নির্যাতনকারীর বর্বর ও নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়েছে এসব নারী-শিশু। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস)-এর প্রতিবেদন মতে, গত ৫ (২০১৯-২০২৩) বছরে দেশে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮৯ জন গৃহকর্মী। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪০ জন, যা মোট নির্যাতনের ২১ শতাংশ এবং হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে, যা মোট নির্যাতনের ১৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতনের শিকার বেশির ভাগ গৃহকর্মীর বয়স ৯ থেকে ১৮ বছর। বেশির ভাগ শিশু পেট-চুক্তিতে কাজ করে। তাদের পারিশ্রমিক নামমাত্র। এ ছাড়া ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুর বয়স ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বিলস এ প্রতিবেদন তৈরি করে।
বিলসের সুনীতি প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের নারী গৃহশ্রমিকদের ওপর শোভনকাজ ও জেন্ডার সহিংসতার বিষয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৬৭ শতাংশ গৃহকর্মী মানসিক নির্যাতন, ৬১ শতাংশ মৌখিক নির্যাতন, ২১ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং ৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
২০২৩ সালে প্রকাশ পাওয়া বিলসের এই গবেষণায় বলা হয়েছে, গৃহশ্রমিকদের ৮৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। এদের মাসিক গড় আয় ৫ হাজার ৩১১ টাকা। পরিবারের খরচ এর দ্বিগুণের বেশি। যারা ২৪ ঘণ্টা ঘরে থাকেন, তাদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, দিনে ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টাও কাজ করেন। গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নীতিমালায় বলা ছুটির সুবিধা পান না তারা। এ ছাড়া ৮৭ শতাংশের কোনো ধরনের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। অসুস্থতার জন্য ছুটি পান অল্পসংখ্যক মানুষ। মজুরিসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পান মাত্র ৭ শতাংশ গৃহশ্রমিক।
গত তিন মাসে রাজধানীতে উচ্চভবন থেকে পড়ে প্রীতি উড়াং, আনোয়ারা ও আসমা বেগম নামে তিন গৃহকর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের বাসার নবম তলা থেকে পড়ে প্রীতি উড়াংয়ের (১৫) মৃত্যু হয়। এর সপ্তাহখানেক পরে রাজধানীর মালিবাগে দশতলা একটি ভবনের ছাদ থেকে পড়ে আনোয়ারা (৪০) নামের এক গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আনোয়ারা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী পুলিশ কমিশনার তরিকুল ইসলামের বাসায় কাজ করতেন। এ ছাড়া গত বছরে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর রামপুরায় বনশ্রী ডি-ব্লকের চার নম্বর রোডের ৩২ নম্বরে বাড়ির ছয়তলা থেকে নিচে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান আসমা বেগম (৪২)। এসব গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সচেতন মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। এসব মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে তারা।
অভিযোগ উঠেছে, এসব গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের পরে হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যার দায় থেকে বাঁচতে ভবনের ব্যালকনি থেকে মৃতদেহ নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় মামলার পরে তদন্ত হয়। প্রকৃত আসামি যেন শাস্তি পায় পুলিশ সেভাবে কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা করতে চায় না, তারা মীমাংসা চায়। সে ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা করে ও ব্যবস্থা নেয়।
গৃহকর্মী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পুলিশ যেসব আসামিকে গ্রেপ্তার করে তারা অনেকে দেখা যায় খালাস পায়, চার্জশিট থেকে বাদ পড়ে, এমনকি জামিনেও বেবিয়ে যায়, এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো গাফলতি রয়েছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করেই চার্জশিট দেয়। প্রকৃত আসামির বাদ পড়া বা খালাস পাওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, এসব মামলায় অনেক আসামি জামিন পায়। তবে সেটা আদালতের ব্যাপার। আমরা মামলার তদন্ত, চার্জশিট ও প্রকৃত ঘটনা বের করার জন্য রিমান্ডও চেয়ে থাকি। তবে দুই একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। পুলিশের কাজ শেষ হলে বিচারের পালা শুরু হয়। সেখানেও তো সমস্যা হতে পারে। যে কারণে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে ভুক্তভোগীরা। এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে।
গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি শুধু কাগজে-কলমে
সরকার ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ২০ লাখেরও বেশি গৃহকর্মীর অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিতে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ পাস করে। এই গৃহকর্মীদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তবে সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও অবহেলায় বিগত ৮ বছর ধরে এই নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
গৃহকর্মী, নিয়োগকর্তা এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাসহ প্রধান অংশীজনেরা এখনো এই নীতি সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। এই নীতি সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এ বিষয়ে গৃহকর্মী নারী-শিশুদের নিয়ে কাজ করা সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যাডভোকেট এ কে এম নাসিম বলেন, ‘গৃহকর্মীদের সুরক্ষা আইন হওয়া খুবই প্রয়োজন। আইন না হওয়ায় নির্যাতন প্রতিরোধের কথা যতই বলি কোনো কাজে আসবে না। সুরক্ষা আইন হলে গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যা কমবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, গৃহকর্মীদের বেশির ভাগই শিশু। শিশুদের গৃহকর্মীর কাজে নিয়োগ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও দেশে এই আইন কেউ মানছে না। তাই আইন হওয়া ও আইনের প্রয়োগ জরুরি। আশা করি, সরকার সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ দ্রুত বাস্তবায়ন করবে।
বেশির ভাগ গৃহকর্মী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হলে তাদের পরিবার ও নিয়োগকর্তা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দিয়ে মীমাংসা করে থাকেন। এ বিষয়ে এ কে এম নাসিম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে হত্যা ও ধর্ষণের পরে টাকা দিয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। এগুলো কোনোভাবেই মীমাংসাযোগ্য অপরাধ নয়। মীমাংসা হওয়ার কারণে এসব অপরাধ বেড়ে চলেছে। তাই সামাজিক প্রতিরোধ ও কঠোর আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন। প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা যেন কোনোভাবেই বেরিয়ে যেতে না পারে সে ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের সচেতন হতে হবে।খবরের কাগজ
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com