লীনা পারভীন:- “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”– ছোটবেলায় মুখস্থ বা আত্মস্থ করা এই অমর বাক্যটি ইদানীং পথহারা পথিকের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসলে কোন শিক্ষা? কী শিখলে একটা জাতির মেরুদণ্ড নির্মাণ হতে পারে? কে দেবে সেই শিক্ষা? কারা সেই কারিগর? এক কথায় সবাই বলবে সেই কারিগর হচ্ছে সমাজের “শিক্ষক” সমাজ। অর্থাৎ, একজন শিক্ষক যা শিখাতে পারেন সেটি সমাজের আর কেউ পারে না। মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি আছে, যেখানে তিনি বলেছেন শিক্ষার্থীর জন্য তার সত্য পাঠ্যপুস্তক হচ্ছে শিক্ষক। ইন্টারনেটে এমন প্রচুর বিখ্যাত মানুষের উক্তি পাওয়া যাবে। যদিও আজকাল আর এসব উক্তির কোনও ভ্যালু কেউ দিতে চায় না। পাত্তাও দেয় না। অথচ একটা সময় এমন উক্তি অনেকে মুখস্থ করতো, আত্মস্থ করতো। কারণ জ্ঞানী বা পণ্ডিত ব্যক্তিদের কথা বেদবাক্য হিসেবেই গণ্য হতো।
আমি শিক্ষক বিষয়ে রচনা লিখতে বসিনি। প্রচণ্ড হৃদয়বিদারক কিছু ঘটনা, যার সঙ্গে সমাজের কিছু “আলোকবর্তিকা”রা জড়িত হয়ে পড়ছে। আগেও যে একদম এমন ঘটনা আসেনি তা নয়, কিন্তু দিন যত যাচ্ছে তত যৌন হয়রানির সঙ্গে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। ভিকারুননিসা নূন আমার কলেজ। অনেক ভালোবাসার জায়গা। দেশের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসায় যখন শিক্ষকদের যৌন হয়রানির মতো ঘৃণ্য কর্মে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা সামনে আসে, তখন সত্যি ভাবনায় পড়তে হয়। আমরা সবাই সামাজিক অবক্ষয়, নীতি নৈতিকতা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করি। টেলিভিশনসহ সব ধরনের গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা বা লেখালেখি হয়। তবে তার বেশিরভাগই হয় তরুণদের কেন্দ্রিক। শিক্ষকদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন সাধারণত করা হয় না, কারণ এই গ্রুপটাকে আমরা ধরেই নিই যে ইনবিল্ট নৈতিকতা নিয়েই আসে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিংয়ে যাওয়া ছাত্রীদের ‘আদর’ করার নামে যৌন হয়রানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এর আগেও ২০১৫ সালে একই প্রতিষ্ঠানের পরিমল নামে আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছিল। পরিমলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালেও ভিকারুননিসার আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছিল আরেক ছাত্রী।
পরপর এত ঘটনা ঘটার পরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা কি কোনও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও কেন সবাই যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করছে না? কোনও জবাবদিহি কি আছে এখানে?
২০০৯ সালে হাইকোর্টের পরিষ্কার নির্দেশনার পরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর থেকেও একটি নির্দেশনামূলক পরিপত্র দেওয়া হয়েছিল সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি বাধ্যতামূলক করণীয় হিসেবে। মাউশির নির্দেশনায় মনিটরিংয়ের কথাও বলা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হাইকোর্ট এবং মাউশি’র নির্দেশ মানতো তাহলে হয়তো এতদিনে অনেক ঘটনাই প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। তাছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনা না মানা কি সরাসরি অবমাননা হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না?
আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি এ ধরনের যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও অনেক বেশি। কিন্তু যথাযথ সচেতনতা আর প্রতিকারের অভাবে নিপীড়িতরা অভিযোগের বিষয়টাকে উপেক্ষা করে আসছে। জানা গেলো যে ভিকারুননিসা নূনের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের কোনও কমিটির বিষয়ে জানতোই না। কেন জানবে না যদি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতো। যদি কমিটি বিষয়ক সচেতনতার কার্যক্রম চালাতো। এই অবহেলার দায় কার? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাকি তাদের যারা চালায় বা তাদের যারা অভিভাবক তারা? নাকি সরকারেরও উদাসীনতারই ফলাফল হচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর চলে আসা নিপীড়ন? সারা দেশে এমনিতেই নারীরা অবহেলিত। তার ওপর বছরের পর বছর চলে আসা কোনও প্রকার নিপীড়নই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাচ্ছে না। শুধু স্কুল বা কলেজ না, বিশ্ববিদ্যালয়েও যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ্যে চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানেও ঘটনা ঘটছে। শিক্ষকরা তো আমাদের কাছে পিতৃতুল্য। একজন পিতা কি তার কোনও সন্তানকে অত্যাচার করতে পারে? কীভাবে সম্ভব?
নৈতিকতার শিক্ষা যারা দেয় তারাই যদি অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাদের আর সম্মানের স্থানে রাখা যায় না। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীর যে সম্পর্ক সেটাকে ধরা হতো সবচেয়ে পবিত্র হিসেবে। অথচ আজকের দিনে সেটাই হয়ে যাচ্ছে কলুষিত আর অপবিত্র। ভয়ের সম্পর্ক দিয়ে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেওয়া যায় কী?
ধরে নিলাম শিক্ষকরাও সমাজেরই অংশ। সমাজে চলে আসা নারী নিপীড়নের পেছনের যে মানসিকতা সেটা থেকে শিক্ষকরাও মুক্ত হতে পারছেন না। কিন্তু পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে যদি নিপীড়কদের হাত থেকে মুক্ত করা না যায়, তাহলে সামনের দিনে সমাজ গঠনের কর্মটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। সমাজের কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য, সেখানে “শিক্ষক” সমাজ একটি নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে।
আমাদের খুব সচেতনভাবেই ভাবতে হবে। কঠোরভাবে চিন্তা করে এর সমাধান বের করতে হবে। সেই সমাধানের প্রাথমিক কাজটিই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা। শিক্ষক হলেই কেউ নিপীড়নের লাইসেন্স পেয়ে যায় না। নিপীড়কের পরিচয় কেবল সে নিপীড়ক। আর একজন নিপীড়কের জন্য কোন মার্সি থাকতে পারে না। কঠোর শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে যেমন প্রতিষেধকের কাজটিকে জোর দিতে হবে, ঠিক তেমনি প্রতিরোধ্মূলক পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে “যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি” গঠনের বিষয়টি ত্বরান্বিত করতে হবে। প্রয়োজনে স্পেশাল টাস্কফোর্স করে কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারেরই করা উচিত। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন যৌন নিপীড়নের মতো জঘন্য অপরাধকে বাঁচতে দেওয়া যায় না। লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com