ডেস্ক রির্পোট:- দেশের হাসপাতালগুলোয় প্রতি বছর চিকিৎসাধীন অবস্থায় বহু রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বের সবখানেই হাসপাতালে মৃত রোগীদের ডেথ রিভিউ বা মৃত্যু পর্যালোচনাকে অতিগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও বাংলাদেশের কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানেই তা পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানসম্মত ও যথাযথভাবে করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ ডেথ রিভিউ না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় ত্রুটি থেকে গেলেও তা শনাক্ত হচ্ছে না। একই সঙ্গে কঠিন হয়ে পড়ছে পরবর্তী রোগীর মৃত্যু প্রতিরোধ ও চিকিৎসার সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণও।
সারা দেশের হাসপাতালগুলোয় প্রতি বছর কত রোগীর মৃত্যু হয় সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না। সরকারি হাসপাতালগুলোয় মৃতের পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য কারো কাছে নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুধু সরকারি হাসপাতালগুলোয়ই অন্তত সোয়া লাখ রোগীর মৃত্যু হয়। তবে এসব মৃত্যুর সঠিক পূর্ণাঙ্গ ক্লিনিক্যাল বিশ্লেষণ ও এ-সংক্রান্ত কোনো জাতীয় তথ্যভাণ্ডারও নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘ডেথ রিভিউ গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই হাসপাতাল থেকে তা পাওয়া যায় না। সরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ভর্তি রোগীর তথ্য এবং মৃত্যুর হিসাব পাওয়া গেলেও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায় না। আমরা তাদের কাছে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় তথ্য চেয়েছি। রোগীদের ডিজিজ প্যাটার্ন-চিকিৎসা এসব জানার জন্য ডেথ রিভিউ প্রয়োজন। রোগীর চিকিৎসা সঠিকভাবে হলো কিনা, কোনো ঘাটতি ছিল কিনা একই সঙ্গে পরবর্তী রোগীর চিকিৎসার সময়েও এ রিভিউ কাজে লাগে। রোগীর মৃত্যুর পর ভারবাল অটোপসি করা হয়। তবে সব রোগীর ক্ষেত্রে হয় না। আর ময়নাতদন্ত, ফরেনসিক প্যাথোলজির পর্যালোচনা করা হলেও সেগুলো খুবই কম। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রেই এসব করা হয়। রোগীর স্বজনরা অনেক সময় ময়নাতদন্তে রাজি হন না। তবে কোনো রোগী হাসপাতালে মারা গেলে তার ডেথ রিভিউ থাকা উচিত।’
দেশে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি গত কয়েক দশকে ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬৪০টি (ইউনিয়ন পর্যায় বাদে)। বেসরকারি হাসপাতাল ৭ হাজার ৮৫৪টি। এ প্রতিষ্ঠানগুলোয় মোট ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩০১টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারিতে ৬৮ হাজারের কিছু বেশি। আর বেসরকারিতে শয্যা রয়েছে প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সরকারি হাসপাতালে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৮৫ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শূন্য থেকে চার বছর বয়সী সাড়ে ২৪ হাজার এবং পাঁচ বছরের বেশি বয়সের রোগী ছিল সোয়া ৯৭ হাজার। মৃতের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন হৃদজটিলতা নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীরা। এরপর রয়েছে স্ট্রোকের রোগী।
তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগী ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালের কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে সব মৃত্যুর পর্যালোচনা করতে হবে। রোগীর হাসপাতালে ভর্তির কারণ আর মৃত্যুর কারণ এক নাও হতে পারে। ফলে কারণ অনুসন্ধানে মৃত্যুর পর্যালোচনা জরুরি। এতে পরবর্তী রোগীর চিকিৎসা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি শনাক্ত করা যায়। একই সঙ্গে কোন রোগে কতজনের মৃত্যু হচ্ছে, তার সঠিক তথ্যও উঠে আসে। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাসপাতালে ডেথ রিভিউর বিষয়টিকে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করা হয়।
হাসপাতালে সব মৃত্যুর ডেথ রিভিউ হতে হবে উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে যেসব রোগীর মৃত্যু হয় তাদের মধ্যে কোন রোগীর কী কারণে মৃত্যু হয়েছে তা পর্যালোচনা জরুরি। কিন্তু দেশে বিষয়টির প্রচলন নেই। কোনো রোগী এক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে এলে তার মৃত্যু ওই সমস্যার কারণে নাও হতে পারে। পর্যালোচনা তিন ধরনের হতে পারে। একটি হলো ডেস্ক অটোপসি। অর্থাৎ রোগীর ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত চিকিৎসা সম্পর্কিত সব রিপোর্ট বিশ্লেষণ করা হবে। আরেকটি হলো অটোপসি। অর্থাৎ রোগীর ময়নাতদন্ত হবে। এতে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে চিকিৎসার সব কাগজপত্র দেয়া হবে। তিনি দেখবেন যে ডেথ অব কজ ঠিক আছে কিনা। তৃতীয় পদ্ধতি হলো ডেথ রিভিউ। এতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্সসহ যারা রোগীর চিকিৎসা যুক্ত ছিলেন তারা একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরবেন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শুধু অপমৃত্যুর ময়নাতদন্ত হয়। দেশে যেসব মৃত্যু করোনার কারণে দেখানো হয়, তাদের সবার মৃত্যু করোনার কারণে হয়নি। প্রত্যেক রোগীর ভিন্ন কারণে মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তা জানা যায়নি। কেননা ডেথ রিভিউ হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি রোগী মারা গেলে তার স্বজনরা প্রশ্ন করতেই পারেন। এটাকে খতিয়ে দেখতে রিভিউ প্রয়োজন। পরবর্তী মৃত্যু প্রতিরোধ, চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতির কারণে, রোগ ও রোগীর জাতীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরিতে এ রিভিউ কার্যকর। হাসপাতালগুলো এ রিভিউ না করার কারণ হতে পারে যে তাদের ত্রুটি মানুষের সামনে এসে যাবে।’
দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছর সাড়ে ১৩ হাজার রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ২ হাজার ২০০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে ওই বছর ভর্তি হয়েছিলেন ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি রোগী। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শামীম আহসান বলেন, ‘এখানে ডেথ রিভিউ যে একদমই নেই তা বলা ঠিক হবে না। হয়তো কাঠামোগতভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে ডেথ রিভিউ হয়। নিয়মিত মেডিকেল অডিট হয়। এতে বৃহৎ পরিসরে হাসপাতালের সব সেবা পর্যালোচনা করা যায়। এছাড়া চিকিৎসক ও অধ্যাপকরা প্রতিদিন মর্নিং সেশনে আগের দিনের মৃত্যুগুলো পর্যালোচনা করেন। সেখানে রোগীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে আলোচনা হয়।’
রাজশাহী অঞ্চলের বৃহৎ চিকিৎসালয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ১ হাজার ২০০ শয্যার এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে প্রতি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি হয় ২৫০ জনের কাছাকাছি। এ হাসপাতালে গত বছর মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ১৪৯ রোগীর। আর মোট রোগী ভর্তির সংখ্যা ২ লাখ ৮৭ হাজারের বেশি।
হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফএম শামীম আহাম্মদ জানিয়েছেন, প্রয়োজনবোধে মৃত রোগীর ডেথ রিভিউ করা হয়। তিনি বলেন, ‘সব মৃত্যুর রিভিউ হয় না। যেগুলোর প্রয়োজন হয়, কেবল সেগুলোই রিভিউ বা পর্যালোচনা করা হয়। এ রিভিউর জন্য আমি কমিটি করে দেই। তারা রিভিউ করার পর আমাকে প্রতিবেদন দেয়। তবে ডেথ রিভিউ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
দেশে অন্তত পাঁচটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেথ রিভিউর জন্য অথবা এ প্রতিবেদন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পাঠানোর জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে মৃত্যুর পর্যালোচনা করতে পারে। তবে এসবের তথ্য জাতীয়ভাবে সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই।
মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন ডা. মো. ফিরোজ জামান। বর্তমানে দিনাজপুর জেলা হাসপাতালের এ সহকারী পরিচালক বলেন, ‘রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসকরা কমেন্ট লেখেন। তবে যে রিভিউর কথা বলছেন, সে সিস্টেম কোথাও তেমন হয় না। কেউ অভিযোগ করলে তখন বিশেষভাবে পর্যালোচনা করা হয়। তবে মা ও শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে পর্যালোচনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।’
হাসপাতালে মৃত্যুর পর্যালোচনা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য সম্পদ এবং পরিষেবা প্রশাসন (এইচআরএসএ)। সংস্থাটি বলছে, ক্লিনিক্যাল মৃত্যু পর্যালোচনা এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে চিকিৎসা ও অন্যান্য বিষয় বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে নিরীক্ষা করা হয়। মৃত্যুর পরিস্থিতি, কারণ অনুসন্ধান ও চিকিৎসা সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় এর মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। পর্যালোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ রোগী মৃত্যু প্রতিরোধের সম্ভাব্য পথও নির্ধারণ করা যায়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতা ও চিকিৎসার পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে হবে কিনা; সেটিও নিশ্চিত করা যায়।
ডেথ রিভিউর বিষয়ে বাংলাদেশে গাইডলাইন নেই উল্লেখ করে পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে কিছুটা করা হয়। তবে তা সব হাসপাতালে হয় না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী কী কী লক্ষণ নিয়ে মারা গেছে তা পর্যালোচনা জরুরি। চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট হাসপাতালে কিছুটা রিভিউ হয়। তবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকের ওপর। তবে কাঠামোগতভাবে তাকেও রিভিউ বলা যায় না। সাধারণত দেখা যায়, রোগী মারা গেলে রোগীর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক একটি মন্তব্য লিখলেন, তবে তা ডেথ রিভিউ হয় না। রিভিউ হলে অবশ্যই জানা যায়, কী কারণে মারা গেল এবং চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি ছিল কিনা তা দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য রোগীর মৃত্যু প্রতিরোধে কাজ করা যায় এবং চিকিৎসা উন্নতকরণে ব্যবস্থা নেয়া যায়।’ বণিক বার্তা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com