ডেস্ক রির্পোট:- গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এবার আলোচনা ও গুঞ্জন চলছে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ তিন সংগঠন- জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, জাতীয়তাবাদী যুবদল ও জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলকে কেন্দ্র করে। কারণ আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকায় এই তিন সংগঠনের দক্ষতা ও তৎপরতার ওপর নির্ভর করছে বিএনপির সফলতা। কিন্তু সেই তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ এই তিন সংগঠন এবার নির্বাচনের আগে রাজপথে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
জানা গেছে, এ নিয়ে তৃণমূল থেকে শুরু করে বিএনপির হাইকমান্ডও প্রচণ্ড হতাশ হয়েছেন। অনেক সময় হাতে পাওয়ার পরও এই তিনটি সংগঠনে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি বলে দলের মধ্যে আলোচনা উঠেছে। ফলে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক তিন সংগঠনকে পুনর্গঠন নিয়ে চলছে আলোচনা। একটি সূত্রের দাবি, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা কারাগার থেকে বের হলেই কমিটি পুনর্গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘পুনর্গঠন চলমান সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ। হাইকমান্ড সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে নতুন কমিটি বা পুনর্গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আগে মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতারা কারাগারে থেকে বের হোক, তারপর দেখা যাবে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘এই ধরনের আলোচনা নেতা-কর্মীদের মাঝে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু দলের মধ্যে এই ধরনের কোনো আলোচনা নেই। তার দাবি, সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যাপক হয়েছে। সেখানে নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।’
বিএনপির এই গুরুত্বপূর্ণ তিন সংগঠন রাজপথে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী হিসেবে একাধিক নেতা বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী কমিটি গঠন করা যায়নি। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠন করলে রাজপথে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করত। নির্বাচনের পর অনেকেই এখন বলছেন, ১৫ বছর ধরে বিএনপি শুধুই হারিয়েছে। অনেক নেতা-কর্মী গুম-খুন হয়েছেন, বাড়িঘর ছাড়া হয়েছে বহু পরিবার। তাই সঠিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে এবার প্রেস রিলিজ কমিটি নয়, কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করার দাবি তুলবেন তারা।
দলটির একাধিক নেতা বলছেন, ঢাকার রাজপথের আন্দোলনে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ভূমিকায় অনেকেই হতাশ। সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেননি এসব দলের নেতারা। অনেকেই ঝিমিয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ সময় পেলেও জেলা, থানা ও থানা কমিটি গঠন করতে পারেননি। যার প্রভাব পড়েছে রাজধানীসহ সারা দেশের এক দফার আন্দোলন-সংগ্রামে। কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা যায়নি। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, তাদের শোকজ করারও কোনো উপায় ছিল না। তাদের কাছে জবাব চাইলে অনেকেই বলছেন, এই সংগঠনের সঙ্গে তারা জড়িত নয়। কোনো পদ তো দেওয়া হয়নি।
তবে একটি ‘বিশেষ চক্র’ অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছে অভিযোগ করে তিন সংগঠনের একাধিক নেতা জানান, সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নামে নানা অপ্রচারও চালাচ্ছেন তারা। অথচ ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির মেয়াদ এখনো রয়েছে। মেয়াদ শেষের আগেই কমিটি ভাঙলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এখন কমিটি ভাঙলে মনোবল হারাবেন নেতা-কর্মীরা, প্রভাব পড়বে সামনের আন্দোলনে।
ছাত্রদল: ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথমে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচ নেতা এবং পরে ১১ সেপ্টেম্বরে ৩০২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট শ্রাবণকে সরিয়ে রাশেদ ইকবাল খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। কিন্তু তার পরও আসেনি সাংগঠনিক কার্যক্রমের গতি। জেলা পদমর্যাদার ১১৮টি সাংগঠনিক ইউনিটের প্রায় ৩০টি জেলায় কমিটি গঠন করেছেন কেন্দ্রীয় কমিটি। বাকি কমিটিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে নেই অনেক ইউনিট কমিটি। অনেক ইউনিট চলছে খোকন-শ্যামল ও আকরাম-রাজীবের দেওয়া কমিটি দিয়ে। দীর্ঘ সময় পেয়েও তারা থানা কমিটি ও জেলা কমিটি দিতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে আধিপত্য কমেছে। এর জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থান না থাকা, অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং-কোন্দলকে দায়ী করেছেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।
তাদের অভিযোগ, সংগঠনের নেতারা বলয়ভিত্তিক রাজনীতি থেকে বের হতে পারছেন না। তাদের দাবি, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ছাত্রদল। ২০১৮ সালের পর থেকেই ছাত্রদল নতুনভাবে গড়ে উঠেছে। ছাত্রদলই প্রথম প্রেস ক্লাবের সামনের সমাবেশের প্রথা ভেঙে ২০২২ সালে পল্টনে সমাবেশ করেছে, যা বিগত কমিটির কেউ করার সাহস দেখাতে পারেনি। ছাত্রদলের মতো অন্য সংগঠনগুলো মাঠে ছিল না বলেও দাবি তাদের।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, ‘জাতির এই সংকটকালে ছাত্রদলই রাজপথে বেশি সক্রিয় ছিল। আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। তার পরও ছাত্রদলের অভিভাবক যদি মনে করে সংগঠনের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন দরকার, এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’ তিনি জানান, সারা দেশে ছাত্রদলের জেলা-থানা কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলমান আছে।
ছাত্রদলের সহদপ্তর সম্পাদক শাহরিয়ার হক শিমুল বলেন, ‘নতুন কমিটি গঠনের গুঞ্জন চলছে। আমাদের প্রত্যাশা, দলে গ্রুপ ও কোন্দলের অবসান ঘটাবে, বলয়প্রথা ভাঙবে এমন সৎ, যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব আসুক।’
যুবদল: সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সভাপতি ও আবদুল মোনায়েম মুন্নাকে সাধারণ সম্পাদক করে যুবদলের ২৫১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। প্রায় সব জেলা ও থানা কমিটি আছে। প্রায় এক বছর কারাগারে থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহীন। আন্দোলনে রাজপথে সামনের কাতারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন নেতা-কর্মীরা। তাই এখনই কমিটি ভেঙে দেওয়া হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘হাইকমান্ডের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয়। তার পরও হাইকমান্ড যদি মনে করে যেকোনো সময় যেকোনো কমিটি ভেঙে বা পুনর্গঠন করতে পারে।’ তার দাবি, যুবদলের কমিটি ভাঙার মতো কোনো পরিস্থিত হয়নি। কমিটির মেয়াদও আছে। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যুবদল রাজপথে সক্রিয় ছিল, সফলতার পরিচয়ও দিয়েছে।
যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান বলেন, কমিটি পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। দল যদি মনে করে নতুন কাউকে নেতৃত্বে নিয়ে আসবে বা কাউকে পদোন্নতি দিতে চাইলে পুনর্গঠন করতে পারে।
স্বেচ্ছাসেবক দল: ২০২৩ সালের ২০ এপ্রিল এস এম জিলানীকে সভাপতি ও রাজীব আহসানকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের ২১৩ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি দেওয়া হয়। সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদক পদমর্যাদার কাজী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সারা দেশে ৮১টি জেলা ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে না পারায় বরগুনা জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১০-১২ ইউনিটে কর্মিসভা করা হলেও এখনো কমিটি দেওয়া হয়নি। আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে ৮০০ থানা ও পৌরসভা। ২৮ অক্টোবরের পর সারা দেশের প্রায় ৪০০ নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন। সম্প্রতি কিছু নেতা জামিনে বের হয়েছেন।
সংগঠনের সভাপতি এস এম জিলানী বলেন, ‘মার্কেটে এসব কথা কিছু লোকে ছড়াচ্ছে, তারা আওয়ামী চরও হতে পারে। দল এখন আগের থেকে সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী। কমিটির মেয়াদ আছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তখন আলোচনা হবে। তার পরও দলের প্রয়োজনে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে হাইকমান্ড।’
স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান বলেন, ‘সংগঠন আরও গতিশীল করতে থানা ও পৌরসভার আহ্বায়ক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে। কমিটি ভেঙে দেওয়া বা পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেবেন হাইকমান্ড।’খবরের কাগজ
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com