ডেস্ক রির্পোট:- পল্লী এলাকার দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। অথচ দারিদ্র্য কমানোর পরিবর্তে নিজেদের আর্থিক উন্নয়নে ব্যস্ত পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। কোনো রকম নিয়মের তোয়াক্কা না করে অবৈধ নিয়োগ, পদোন্নতি ছাড়াও নানারকম অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ নিয়েও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। সব মিলিয়ে যেন অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন।
জানা গেছে, পিডিবিএফের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে রয়েছেন মুহম্মদ মউদুদউর রশীদ সফদার। যাকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিন বছর মেয়াদে এমডি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আরও তিন বছর মেয়াদ বাড়িয়ে আবার নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, এমডি পদে মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাকরির প্রবিধানমালা মানা হয়নি। এমনকি মউদুদুউর রশীদ সফদারের এমডি পদে পুনরায় তিন বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য চাকরি প্রবিধানমালা সংশোধন করা হয়েছে; কিন্তু প্রবিধানমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করার আগেই মেয়াদ বৃদ্ধি করে পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পিডিবিএফের চাকরি প্রবিধানমালা যাচাই করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রবিধানমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়; কিন্তু মউদুদুউর রশীদ সফদারকে মেয়াদ বাড়িয়ে এমডি পদে আবার নিয়োগ দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর। এর আগে ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর পিডিবিএফের ৯৪তম বোর্ড সভায় এমডি মউদুদুউর রশীদকে আবার চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়। নিয়োগ পত্র বা চাকরি প্রবিধানমালায় মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে উল্লেখ না থাকায় একই সভায় প্রবিধানমালা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়।
এমনকি মউদুদুউর রশীদকে এমডি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সসীমা নিয়েও লুকোচুরি করা হয়েছে। ২০২০ সালের প্রবিধান অনুযায়ী এমডি পদে চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৬২ বছর; কিন্তু তাকে পুনরায় নিয়োগ দিতে সংশোধিত চাকরির প্রবিধানমালা থেকে বয়সসীমা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার চাকরির বৈধতা দিতেই এমনটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
এদিকে, বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত বয়স শেষ হওয়ার পরেও এমডি পদে চাকরির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠানটির এক সাবেক কর্মী ২০২২ সালের নভেম্বরে উচ্চ আদালতে রিট করেন। সেই রিটে বলা হয়, পিডিবিএফের এমডি নিয়োগ ও চাকরি প্রবিধানমালা-২০২০ অনুযায়ী ৬২ বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় ২০২২ সালের ২৪ আগস্টের পর থেকে তিনি পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে অবৈধভাবে চাকরি করে যাচ্ছেন।
তিন বছরের অধিকসময় ধরে এমডি পদে আছেন মউদুদুউর রশীদ। এ সময় তার বিরুদ্ধে উঠেছে নানা ধরনের অনিয়মসহ অসংখ্য অভিযোগ। নিয়োগ এবং পুনরায় বেআইনিভাবে মেয়াদ বৃদ্ধির অভিযোগ তুলে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সচিব বরাবর আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা। এ ছাড়া এমডি নিয়োগে অনিয়মসহ প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে দুটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন পিডিবিএফের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শ্বেতপত্র দুটিতে অর্থের বিনিময়ে সর্বনিম্ন দরদাতাকে না দিয়ে তৃতীয় প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া, বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়া ঋণ শিডিউল করা, অর্থের বিনিময়ে উচ্চতর পদে পদায়ন, আদালতে চলমান মামলা নিষ্ক্রিয় রেখে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়ার অপচেষ্টা, ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে স্ট্রিট লাইট প্রকল্প বাস্তবায়ন, মুদ্রণসামগ্রী ও মালপত্র সরবরাহকারীর মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং ভুয়া কাগজপত্রে নিয়োগসহ মোট ৫৫টি অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
নিয়োগে অনিয়ম এবং তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবিএফের এমডি মুহম্মদ মউদুদুউর রশীদ সফদার বলেন, অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। নিয়োগ নিয়ে যা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে। এটাতে অনিয়মের কিছু নেই। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, যারা এ অভিযোগগুলো যারা তুলছে তারা ভুল তথ্য দিচ্ছে। তাদের পড়াশোনাও যেমন কম একই সঙ্গে তথ্য সম্পর্কে ধারণাও কম।
শুধু এমডি নিয়োগে অনিয়ম নয়, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন যেন অনিয়মের স্বর্গরাজ্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিডিবিএফের কর্মকর্তারা দারিদ্র্য কমানোর বদলে নিজেরাই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ঋণের টাকা আত্মসাৎ, দরপত্র ছাড়া বেশি দামে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়, মালপত্র না দিলেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ, পিডিবিএফের টাকা ব্যাংকের বদলে নিজেদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে জমা করা, অবৈধ নিয়োগ এবং বদলি বাণিজ্যসহ হেন কোনো দুর্নীতি নেই যাতে পিডিবিএফের কর্মকর্তারা জড়িত নেই।
পিডিবিএফের অনিয়মের চিত্র খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের বিশেষ নিরীক্ষায়ও উঠে এসেছে। সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন পিডিবিএফে ১৬ ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৬০৮ কোটি ৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। পিডিবিএফের ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ তিন অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে সিএজি কার্যালয়। এতে বলা হয়, আর্থিক বিধিবিধান পরিপালন না করায় এসব অনিয়ম হয়েছে। পদে পদে সরকারি ও প্রতিষ্ঠানটির বিধিবিধান লঙ্ঘন করায় সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দারিদ্র্য বিমোচন প্রতিষ্ঠানে মোট ১৬ ধরনের অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
গুরুতর অনিয়মের মধ্যে রয়েছে সরকারি কেনাকাটা বিধিমালা (পিপিআর) ও সরকারি বিধিবিধান ও পিডিবিএফের নিজস্ব বিধান অনুসরণ না করা, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ও সরকারি অর্থ আদায় ও জমার ক্ষেত্রে অনিয়ম করা হয়েছে। এ ছাড়া অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিতে ব্যাংকের টাকা লিজিং কোম্পানিতে রাখা এবং ব্যবস্থা না নেওয়ার আর্থিক অনিয়মগুলো সংগঠিত হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যোগ্যতা না থাকার পরেও পিডিবিএফে নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নীতিমালা লঙ্ঘন করে ব্যাংকের বদলে ৫ লিজিং কোম্পানিতে ৪৩ কোটি টাকা জমা রাখা হয়। চেষ্টা করেও লিজিং কোম্পানি থেকে সেই অর্থ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। সোলার হোম সিস্টেমের মালপত্র না দিলেও ঠিকাদারকে ৫৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ১৮ হাজার টাকার সোলার হোম সিস্টেম কেনা হয়েছে ৩৯ হাজার ৫০০ টাকায়। এতে ২০১৭-১৮ থেকে পরের তিন অর্থবছরে ক্ষতি হয় ৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৯ ঋণগ্রহীতার কাছে ২১৮ কোটি টাকা ঋণ আদায় হয়নি।
এ ছাড়া দরপত্র আহ্বান না করে একক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়তি দামে ১৫৮টি কার্যাদেশের মাধ্যমে ৮৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সোলার সিস্টেম কেনা হয়। এতে পিডিবিএফের আর্থিক ক্ষতি হয় ২২ কোটি ২১ লাখ টাকা। আর অনিয়মিত ব্যয় হয় ৮৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তিন অর্থবছরে ৮ হাজার ৩৭৯টি সোলার হোম সিস্টেম কেনা হয়, যার ৯৫ শতাংশই অকার্যকর ও নিম্নমানের। ফলে পিডিবিএফের আর্থিক ক্ষতি হয় ১৭ কোটি ২২ লাখ টাকা।
সৌর প্রকল্পে নতুন মালপত্রের পরিবর্তে পিডিবিএফের পুরোনো ও নষ্ট মালপত্র সরবরাহ করেই ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। এই টাকা সংস্থার অতিরিক্ত পরিচালক সহিদ হোসেন (সেলিম) ও তার ভাগনে সাইফুল ইসলামের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। পিডিবিএফ সূত্র জানায়, সহিদ বর্তমানে সংস্থাটির মাঠ পরিচালনা বিভাগের প্রধান, সাইফুল বগুড়ার শেরপুর কার্যালয়ে সহকারী হিসাব কর্মকর্তা।
২০১৭ সালের আগে পিডিবিএফের মাঠ সংগঠক পদে নিয়োগের জন্য ৩০৪টি চাহিদা দেওয়া হয়; কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষার ফল জালিয়াতি করে বোর্ডের অনুমোদন ও নিয়োগ কমিটির সুপারিশ ছাড়া ৭২৭ জনকে অর্থাৎ চাহিদার অতিরিক্ত আরও ৪২৩ মাঠ সংগঠক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া যোগ্যতা না থাকা শর্তেও দেওয়া হয়েছে নিয়োগ। একই সঙ্গে অবৈধভাবে দেওয়া হয় পদোন্নতি। নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও সংস্থাটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক শফিউল ইসলাম ২৪ প্রার্থীর নম্বর জালিয়াতি করেন। এই নিয়োগের ফলে পিডিবিএফের ৪৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। এসব মাঠ সংগঠক এখনো কর্মরত।
ভুয়া কাগজপত্র দিয়েও পিডিবিএফে নিয়োগ পেয়েছেন অনেকে। সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনও এমন তথ্য উঠে এসেছে। অডিটে ৪৫ জন কর্মকর্তার নিয়োগে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা সনদ এবং আবেদনের যোগ্যতা না থাকার পরেও তাদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে, বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো অনেককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক এমডি আমিনুল ইসলাম বলেন, বোর্ডের সিদ্ধান্তে মামলা করেছিলাম। সরকার বাদী এমন মামলা কীভাবে খারিজ হলো, সেটা জানা নেই। মামলা খারিজ হলেও আপিল করার সুযোগ রয়েছে; কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ খারিজের বিরুদ্ধে এখনো আপিল করেনি। আপিল না করা সন্দেহজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, মামলার আসামিদের বাঁচাতেই হয়তো আপিল করা হচ্ছে না।
সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে পল্লী ও সমবায় বিভাগের সচিব এবং পিডিবিএফের চেয়ারম্যান মোসাম্মৎ হামিদা বেগমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। দুদিন ধরে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি তার ফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপে পরিচয় দিয়ে মেসেজ দিলেও সাড়া মেলেনি।কালবেলা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com