হাসান মামুন:- দেশে নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ানোর যে ‘আয়োজন’ চলছে, এতে বিশেষ করে উদ্বেগ বাড়বে তাঁদের, যাঁরা গত কয়েক বছরে আয় বাড়াতে পারেননি। আয় বাড়ালেই হবে না; চলমান মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে বাড়াতে হবে। এমন একটা জনগোষ্ঠী দেশে থাকলেও এর সদস্য তো কম। নিত্যপণ্যের সঙ্গে ওষুধের দাম দফায় দফায় বাড়লেও তাঁদের কিছু যায়-আসে না।
তাঁরা চাইলে খাদ্যাভ্যাস বদলাতে এবং জিমে অর্থ ব্যয়ও বাড়াতে পারেন। সন্দেহ নেই, এর কিছু সুফল রয়েছে। তাঁদের বাড়তি ব্যয়ে কিছু কর্মসংস্থান তো হয়ে থাকে। তবে দেশের নিম্ন আয়ের সিংহভাগ মানুষের জন্য এই দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রচেষ্টা গ্রহণের খবর উদ্বেগজনক।
অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও দীর্ঘ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। তখনো চিকিৎসায় অনেক জটিলতা মোকাবিলা করতে হয় মানুষকে। পরিস্থিতি অবশ্য আরও খারাপ হতে পারত। তেমনটা না হলেও যেসব পরিবারে করোনা হানা দেয়, তাদের চিকিৎসা ব্যয় হঠাৎ যায় বেড়ে। কাউকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁর ব্যয় সংকুলান হয়ে ওঠে বিশেষভাবে কঠিন। ভালো যে, ওই সময়টায় সাধারণভাবে ওষুধের সংকট হয়নি; দামও বেড়ে যায়নি সেভাবে। যাঁরা করোনার চাপ থেকে মুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও অবশ্য আয় কমে গিয়েছিল লকডাউনসহ অর্থনীতি গতি হারানোয়। সেটি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, এর চাপ গিয়ে পড়েছে দেশের ওষুধশিল্পেও। কিছুদিন পরপরই বলা হচ্ছে, উৎপাদন ও ব্যবসার ‘ক্রমবর্ধমান খরচ’ জুগিয়ে তাদের পোষাচ্ছে না। ওষুধের দাম তাই আরও বাড়াতে হবে।
‘আরও বাড়ানো’র কথাটা বলতে হলো এ জন্য যে করোনা-পরবর্তীকালে, বিশেষ করে গত দেড়-দুই বছরে বেশ কিছু ওষুধের দাম কিন্তু বাড়ানো হয়েছে। ওষুধ উৎপাদনে আমরা পর্যায়ক্রমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। বেশ কিছু দেশে রপ্তানিও হচ্ছে এবং এ খাতে রয়েছে প্রবৃদ্ধি।
দেশের বাইরে বড় একাধিক কোম্পানি প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করছে বলে খবর আমাদের আনন্দিত করে। ওষুধ খাতে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যাঁরা একদা লড়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই প্রয়াত। তবে তাঁদের কাজের সুফলটা রয়ে গেছে। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য তো কেবল স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ছিল না। তাঁরা জোর দিয়েছিলেন ওষুধের মান নিশ্চিতকরণ এবং দাম জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার ওপর। ওষুধকে তাঁরা এমনকি আর দশটি সাধারণ নিত্যপণ্যের সঙ্গে তুলনা করতেও নারাজ ছিলেন। বলা হতো, এটা একটা ‘নিয়ন্ত্রিত পণ্য’। সব ওষুধের দামই সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিলেন তাঁরা।
সেই অবস্থান থেকে অবশ্য ক্রমে সরে এসেছে সরকার এবং অল্প কিছু ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ’ বাদে আর সব ওষুধের দামই এখন নির্ধারিত হচ্ছে কোম্পানির বক্তব্যের ভিত্তিতে। অত্যাবশ্যকীয় বেশ কিছু ওষুধের দামও কিন্তু মাঝে বাড়ানো হয় উল্লেখযোগ্যভাবে। এর মধ্যে মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যবহৃত প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধও রয়েছে। কোম্পানিগুলো বলছিল, এসবের দাম দীর্ঘদিনেও বাড়ানো হয়নি–উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও। সরকারনির্ধারিত দামে এসব ওষুধ বানিয়ে সরবরাহ করতে গিয়ে তাদের নাকি লোকসান হচ্ছিল! ওই একই সময়ে তালিকার বাইরে থাকা বেশ কিছু ওষুধের দামও বাড়ানোর অনুমতি দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ইনসুলিন, স্যালাইন প্রভৃতি।
গেল কয়েক মাস ডেঙ্গু আমাদের ভুগিয়েছে অনেক এবং গ্রাম পর্যন্ত এটা ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে ঘটেছে রেকর্ড মৃত্যু আর ব্যয়ের চাপে কাহিল হয়ে পড়েছে বহু পরিবার। করোনার সঙ্গে তুল্য না হলেও এটাও কম দুর্যোগময় পরিস্থিতি ছিল না। নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ানোর যে আয়োজন দেখা যাচ্ছে, সেটি ঘটলে ওই সব পরিবারেও শুধু ওষুধ কিনতে বাড়তি ব্যয়ের চাপ সৃষ্টি হবে।
এটা সামাল দিতে গিয়ে অগত্যা অনেককে খাদ্যদ্রব্য পরিভোগেও বদল আনতে হয়। তাতে ঘটে পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি। নিত্যপণ্যের দাম যখন সাধারণভাবে বেড়ে চলেছে, এমনকি চালের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় সরকার উদ্বিগ্ন, তখন আবার ওষুধের দাম বেড়ে গেলে সেটাকে ‘সামান্য’ বলা যাবে না। ওষুধশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তরা তাঁদের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলতে সম্প্রতি দেখা করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টার সঙ্গে। তিনি নিজেও একটি বড় ওষুধ কোম্পানির মালিক। ওষুধশিল্পের সমস্যাগুলো তাঁরও ভালোই জানা থাকার কথা। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ওষুধের দাম বাড়ানোর দাবির নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
ওষুধের দাম যেহেতু মাঝে বাড়ানো হয়েছে, সুতরাং এখন আর বাড়ানো যাবে না–এভাবে বলাটা নিশ্চয় সংগত নয়। মাঝে সব ওষুধের দাম বেড়েছে, সেটাও নয়। দাম বাড়ানোর সব প্রস্তাবে ঔষধ প্রশাসনও নিশ্চয় সাড়া দেয়নি বা মাঝামাঝি কিছু একটা হয়েছে। ওষুধের দাম বাড়তে না দেওয়ার একটা চেষ্টা তো সরকারের দিক থেকে থাকে এবং সেটাই স্বাভাবিক। সেই ধারাতেই বেশ কয়েক বছর সরকার তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম একটুও বাড়তে দেয়নি।
নির্দিষ্ট দামে এসব ওষুধ উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে কোম্পানিগুলো যেন আবার সরবরাহ সংকট তৈরি না করে, সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হয়েছিল। এখন তালিকার বাইরে যে বিপুলসংখ্যক ওষুধ বাজারে রয়েছে, সেগুলোর মূল্য বৃদ্ধির দাবির গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্যান্য শিল্পের মতো ওষুধশিল্পেও উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, এটা ধরেই নেওয়া যায়। ওষুধের কাঁচামালে যেহেতু ব্যাপক বিদেশনির্ভরতা রয়েছে, তাই শুধু চলমান ডলার-সংকটেই এ ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আমদানির উৎসে ওষুধের কাঁচামালের দামও বাড়তে পারে।
এখন কোন কোম্পানি কোত্থেকে কত দামে আমদানি করে এবং এ ক্ষেত্রে কোনো কারচুপি আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অব্যাহতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ডিজেলের দাম; ওষুধশিল্পে নিয়োজিতদের বেতন বৃদ্ধিও বাস্তবতা বৈকি। প্রতিবার ওষুধের দাম বাড়ানোর দাবি উত্থাপনের সময় এসব বক্তব্য খাতটি থেকে তুলে ধরা হয়। কথা হলো, তাদের বক্তব্যের সঠিকতার মাত্রা নির্ণয় করা প্রয়োজন।
সেই সাধ্য বা প্রয়াস কি ঔষধ প্রশাসনে রয়েছে? হাজার হাজার জেনেরিক ও ব্র্যান্ডের ওষুধ বাজারে আসতে থাকলেও সরকার কি পেরেছে সেগুলোর মান পরীক্ষার ব্যবস্থায় প্রসার ঘটাতে? ওষুধের দামের সঙ্গে মানের বিষয়টি কিন্তু রয়েছে। ওষুধ সেবনকারীদের সন্দেহ দূর করে তাঁদের আশ্বস্ত রাখাও তো প্রয়োজন। ১৯৮২ সাল থেকে গ্রহণ ও সংশোধন করা নীতির প্রভাবে দেশ থেকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিদায় নেওয়ার প্রেক্ষাপটেও কিন্তু ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের মনে। কোনো শিল্পের বিকাশের সঙ্গে এর নজরদারি বাড়াতে না পারলে এমন অবিশ্বাস থাকাটা বিচিত্রও নয়।
ওষুধের দাম বেশি থাকা কিংবা এর মূল্য বৃদ্ধির জন্য অনেকে চিকিৎসকদের পেছনে কোম্পানির ‘অনৈতিক ব্যয়ের’ প্রসঙ্গও তোলেন।ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোরও এ ধরনের ব্যয় রয়েছে এবং এর চাপ গিয়ে অবধারিতভাবে পড়ে রোগীর ওপর। ওষুধ ও রোগ পরীক্ষার পেছনেই বেশির ভাগ ব্যয় হয়ে থাকে এবং এর সিংহভাগই যায় ব্যক্তির পকেট থেকে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রাষ্ট্রের বদলে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় এ দেশে অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে ওষুধশিল্প থেকে ওঠা এর মূল্য বৃদ্ধির দাবি মোকাবিলায়।
ওষুধ জরুরি পণ্য হলেও এর বেসরকারি উৎপাদকেরা তো লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন না। এ অবস্থায় তাঁরা সত্যিই ব্যয় বৃদ্ধির চাপে থাকলে সরকারকে এ খাতে ভর্তুকি জুগিয়ে হলেও ওষুধের দাম আরও বাড়ানোর চাপ থেকে ক্রেতাদের রেহাই দিতে হবে। অনৈতিক ‘মার্কেটিং কস্ট’ নিয়ে অবশ্য কোম্পানিগুলোকে প্রশ্ন করা দরকার। এই চর্চা বন্ধে অনেকে অবশ্য জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখা বাধ্যতামূলক করার ওপর জোর দিয়ে আসছেন।
নতুন মেয়াদের সরকারে চিকিৎসক হিসেবে বড় সুনামের অধিকারী যিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন, তিনি অনিষ্পন্ন এসব ইস্যুতে হাত দিলে মানুষ খুশি হবে। তবে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন হবে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়। যেমন ওষুধের কাঁচামাল আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে শুল্কছাড় দিয়ে ভূমিকা রাখতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। রাজধানীর অদূরে গজারিয়ায় যে ‘এপিআই শিল্পপার্ক’ হয়েছে, সেটিতে বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নিয়ে গিয়ে তা কাজে লাগানোর ব্যাপারে অগ্রগতি কিন্তু কম।
এটা করা গেলে কাঁচামালে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে এনে ওষুধের দাম কমানোও নাকি সম্ভব। কিন্তু জানা যাচ্ছে, সেখানে গ্যাস সরবরাহে সংকট! কাজ শুরুর অনুমতি লাভে জটিলতাও রয়েছে। সেটা না হয় দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে দূর করা গেল; কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় ওখানে গ্যাস জোগানো তো সহজ নয়।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com