রেজোয়ান হক:- ইতিমধ্যেই সবাই জানি ৩৬ সদস্যের নতুন মন্ত্রিপরিষদে পুরোনোদের মধ্য থেকে টিকেছেন মাত্র ১৭ জন। তাঁদের কারও কারও ডাবল প্রমোশন হয়েছে; যেমন শিক্ষা উপমন্ত্রী থেকে পুরো মন্ত্রী, কারও প্রমোশন হয়েছে, কাউকে আগের দায়িত্বেই রাখা হয়েছে, আবার কাউকে আগের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়ায় ডিমোশন হয়েছে।
তারপরও তাঁদের জন্য স্বস্তির ব্যাপার হলো টিকে যাওয়া। কারণ আগের মন্ত্রিপরিষদের ১৪ জন পূর্ণ মন্ত্রীর এবার জায়গা হয়নি। তাঁদের প্রায় সবাই পুরো পাঁচ বছর মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের বাদ পড়ার নানা কারণ থাকতে পারে। হয়তো তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারেননি বা তাঁদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল অথবা অন্য কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রী ফের তাঁদের দায়িত্ব দিতে চাননি, যেটা আমরা জানি না।
প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ছয় এবং উপমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে দুই। আমরা স্মরণ করতে পারি, সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার সময় তখনকার এমপিদের মধ্যে প্রায় ৭০ জন বাদ পড়েছিলেন। এই দুই ক্ষেত্রেই এটা মনে হয়, দলের সভাপতি তাঁর এমপি এবং মন্ত্রীবহরে পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন।
সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদের মধ্যে এমপিদের কাউকে বদল করা যায় না, কিন্তু মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে করা যায়। অথচ আমরা দেখেছি, গত মন্ত্রিসভার প্রায় সবাইকে পাঁচ বছর রাখা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অদক্ষতা বা অন্য কোনো কারণে এবার যে ২২ জন মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ পড়লেন, তাঁদের তাহলে পাঁচ বছর ধরে দায়িত্বে রাখা হয়েছিল কেন?
নাম ধরে ধরে আলোচনা করা যাক। কৃষিমন্ত্রী ছিলেন ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক। তিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। এবারের নির্বাচনে দলের ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির নেতা করা হয়েছিল তাঁকে। দলের গত সম্মেলনে পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যাঁদের নাম শোনা গিয়েছিল, তিনি তাঁদের একজন ছিলেন। তিনি কেন বাদ পড়লেন তা নিয়ে আলোচনায় বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আটক করা, তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে দলটিকে নির্বাচনে আনার প্রস্তাব দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে ভোটের মাত্র কয়েক দিন আগে নির্বাচনে একটি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে তিনি খোলামেলা কথাবার্তা বলেছিলেন, যা দলের জন্য বিব্রতকর ছিল। দল তাঁর এই বক্তব্য গ্রহণ করেনি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, তিনি মিথ্যা কিছুই বলেননি। এটি ছাড়া তাঁর ব্যাপারে আর কোনো সমস্যার কথা প্রকাশ্যে আসেনি। তাই তাঁর পুরো মেয়াদে থাকা নিয়ে তেমন প্রশ্ন নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী দুজনই বাদ পড়েছেন। এর মধ্যে মন্ত্রী বেশ কয়েকবার বেফাঁস মন্তব্য করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যাপারেও নানা সময় অভিযোগ উঠেছিল; বিশেষ করে সরকার-সমর্থক ডাক্তারদের সংগঠনের সমর্থন তিনি খুব একটা পাননি। বাণিজ্যমন্ত্রী সমালোচিত ছিলেন বাজারের জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়; বরং কখনো কখনো তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাজার সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। সমাজকল্যাণমন্ত্রী এবং বন ও জলবায়ু পরিবেশ পরিবর্তনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ মিডিয়ায় এসেছিল। ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিদেশে সম্পদ গড়ার অভিযোগও এসেছিল মিডিয়ায়। অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল সরকারি কাজকর্মে সময় না দেওয়া। তিনি অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, একবার তো সংসদে বাজেট পেশের সময় তাঁর বক্তব্যের খানিকটা প্রধানমন্ত্রীকেও পড়ে শোনাতে হয়।
বাদ পড়া বাকি মন্ত্রীদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ আঁচ করা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই এমন কোনো কারণ আছে, যে জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আবার দায়িত্ব দিতে চাননি।
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাননি। সুতরাং মন্ত্রিপরিষদে তাঁদের ফিরে আসার কোনো প্রশ্নই নেই। আবার মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী। তাঁদেরও মন্ত্রিপরিষদে আবার ঠাঁই পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
নির্বাচিত হয়েও বাদ পড়া বাকি প্রতিমন্ত্রীদের কারও ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগের কথা শোনা যায়নি। তাহলে তাঁদের বাদ পড়ার ক্ষেত্রেও একই কারণ ধরে নেওয়া যেতে পারে যে তাঁরা আবার দায়িত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জন করতে পারেননি। একই কথা প্রযোজ্য দুজন উপমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও।
শরীরের রক্তনালিতে চর্বি জমে অথবা অন্য কোনো কারণে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে ডাক্তাররা বাইপাস অপারেশন অথবা স্টেন্টিং করেন। অনেকেই বলেন, এতে শরীরের মেরামত হয়ে যায় এবং আগের চেয়েও ভালোভাবে কাজ করে।
যা বলতে চাইছি তা হলো—কোনো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই হোক অথবা তাঁদের কোনো দক্ষতার ঘাটতির কারণেই হোক, যাঁরা এবার বাদ পড়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই পুরো পাঁচ বছরই দায়িত্বে না রেখে কেন আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? মন্ত্রিপরিষদে রদবদল সারা দুনিয়ায়ই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমাদের দেশে কেন জানি এটাকে সহজভাবে নেওয়া হয় না। সম্ভবত এমন ধারণা থেকে যে এতে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। মন্ত্রীদের কেউ অদক্ষ হলে বা দুর্নীতি-অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত হলে, অভ্যন্তরীণ তদন্তে প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে সে ক্ষেত্রে রদবদল আনার সংস্কৃতি চালু করা দরকার। এ রকম করা হলে সবার মধ্যে এই বার্তা যাবে যে কোনো কিছুই ‘গ্রান্টেড’ নয়।
নতুন মন্ত্রিপরিষদ কাজ শুরু করতে না– করতেই এ প্রসঙ্গ তুলতে হলো বলে দুঃখিত। কিন্তু কথায় আছে—সাবধানের মার নেই।
রেজোয়ান হক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com