ঢাকা: চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের যে সংলাপ হতে যাচ্ছে, সেখানে দুই দেশের মধ্যকার অনেক বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গও উঠতে পারে। আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলবে বলে আভাস দিয়েছেন দেশটির অন্তত দুজন কূটনীতিক।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুই মন্ত্রীর সংলাপ শুরু হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার। পরদিন শুক্রবারও তা চলবে। এই সংলাপে যোগ দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। মার্কিন দুই মন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগেই দিল্লি পৌঁছাবেন দেশটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু। লুর সফরসূচি ঘোষণা করতে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবার বলেছে, মন্ত্রী পর্যায়ের এই সংলাপে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে স্ট্র্যাটেজিক (সার্বিক ও দীর্ঘস্থায়ী স্বার্থের) সমন্বয়সহ অনেক ইস্যু আলোচনায় আসবে।
লুর সফরের ঘোষণার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে এখানকার জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গও ভারতের সঙ্গে সংলাপে তুলতে চান লু।
এবারের সংলাপে বাংলাদেশে নির্বাচন প্রসঙ্গে ভারতের সঙ্গে মার্কিনদের মতভেদ ও ঐকমত্য যা-ই ঘটুক, এই অঞ্চলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয় কূটনীতিকেরা। এ কারণে ঢাকা, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন—এই তিন রাজধানী থেকেই সংলাপটির ওপর নজর থাকবে বলে বাংলাদেশের এক ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক জানান।
কূটনীতি-বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবিরও মনে করেন, ভারতের সঙ্গে এবারের সংলাপে মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গটি তুলবেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত গতকাল রোববার আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখানে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আঞ্চলিক তাৎপর্যের সঙ্গে ২০২৩ সালের ভোটের তারতম্য আছে। ওই দুই ভোটের পর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের প্রভাব বেশ বেড়ে যাওয়ায় এই তারতম্য তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় ও বিদেশি কয়েকজন বিশ্লেষক বলেন, ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়া-কমার বিষয়ে ভারতের অবস্থান ও কৌশলকে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় পুরোপুরি মেনে নিত। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে মার্কিনদের মনোভাব বদলাতে শুরু করে। সেবার ভোটের ঠিক আগে আগে ভারতের তখনকার পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফর এবং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থনকে যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের আগে-পরে বাংলাদেশে দেশটির প্রভাব বাড়তে থাকার বিষয়ে মার্কিনরা ভারতকে সতর্ক করলেও দেশটি তা আমলে নেয়নি।
২০১৮ সালের ভোটের পর বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের অভিমত বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়ার অবস্থান থেকে সরে আসে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছরের ১৪ নভেম্বর দেশটির স্ট্র্যাটেজিক মিত্র জাপানের তখনকার রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ২০১৮ সালে ‘ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির’ সমালোচনা করলে চীনবিরোধী ব্লকের দেশগুলোতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নতুন চিন্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, আগামী নির্বাচন ও বিরোধী দলগুলোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিষয়ে গত ১৬ অক্টোবর ভারত সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন নয়াদিল্লি সফরে থাকা বাংলাদেশের একদল সাংবাদিক। জবাবে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, তারা তাদের সংবিধান অনুযায়ী চলবে।
সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপের সময়ে ভারতের এমন মন্তব্য নির্বাচনী কৌশলের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানের প্রতি ভারতের একপেশে সমর্থন বলে মনে করছেন ঢাকার কূটনীতিকেরা।
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ মার্কিন বলয়ের সাতটি দেশ আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্য পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়ে গত ৩০ অক্টোবর যৌথ বিবৃতি দেয়। এতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চীনবিরোধী ব্লকের বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে যায় বলে মনে করেন বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা।
এমন পরিস্থিতিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপ শুরু হচ্ছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে অনুষ্ঠানের পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে বলে জানিয়ে রেখেছে দেশটি। নিষেধাজ্ঞার ব্যাপ্তি শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞায় এবং নির্বাচনের মধ্যেই সীমিত থাকবে, এমন নিশ্চয়তা দিতে নারাজ ঢাকায় দেশটির কূটনীতিকেরা। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের এক কূটনীতিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থায় নিষেধাজ্ঞার কোনো মৌসুম নেই। সংশ্লিষ্ট যেকোনো কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো সময় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, সেই সুযোগ আছে।’
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com