মতিউর রহমান চৌধুরী:- ক’দিন আগে দ্য ইকোনমিস্টের এক রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, বাংলাদেশের মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তবে তারা লন্ডনে বসে না বললেও বাস্তবতা আমাদের সবারই জানা। ঢাকার মিডিয়া মোটামুটি নীরব। এটা গেল কয়েক বছরেরই চিত্র। বিশেষত; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর থেকে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ আইন নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। বাদ-প্রতিবাদও কম হয়নি। আন্তর্জাতিক দুনিয়াও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ধারাবাহিকভাবে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের তরফে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের আহ্বান জানানো হয়। এ নিয়ে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ আইনের কোনো সংশোধন করা হয়নি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চোখ রাঙানির মধ্যেই অনলাইন দুনিয়া সংশ্লিষ্ট আরও বেশ কয়েকটি আইন, নীতিমালা দরজায় কড়া নাড়ছে। সংশ্লিষ্ট নানা মহল থেকে প্রস্তাবিত এসব আইন ও বিধিমালার ব্যাপারে আপত্তি জানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এসব নতুন বিধান মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথ আরও রুদ্ধ করবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তৈরি উপাত্ত সুরক্ষা আইন-২০২২ (ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট) নিয়ে। বিশেষত; আন্তর্জাতিক মহল প্রস্তাবিত এ আইন নিয়ে সবচেয়ে সরব। দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যবসা করা বিদেশি কোম্পানিগুলো এ আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আমরা এ নিয়ে কড়া মন্তব্য করতে দেখেছি। সর্বশেষ ৯ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা এ নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। বলা হচ্ছে, সবাই মতামত দিতে পারবে। তবে কথা হচ্ছে, এসব মতামত কি গ্রহণ করা হবে? অতীত অভিজ্ঞতা কিন্তু সুখকর নয়। মোটাদাগে বলা যায়, এই নতুন আইন বাংলাদেশের ডিজিটাল গভর্ন্যান্সকে ভিন্নদিকে নিয়ে যাবে। DPA হচ্ছে প্রথম ডেটা প্রাইভেসি আইন যা বাংলাদেশে প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশ্য কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে এ ধরনের নানা কিসিমের আইন পাস হয়েছে। ব্যবসায়িক কার্যকলাপে বিধিনিষেধ আরোপের জেরে এই অ্যাক্ট প্রচ- সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ডিজিটাল পরিষেবায় খরচের কথাও উল্লেখ রয়েছে। যাতে সার্ভারে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ আসতে পারে। যদিও বাংলাদেশের বাজার তুলনামূলকভাবে ছোট। এ কারণে বাংলাদেশের ভোক্তাদের কাছে এই পরিষেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হতে পারে। এসব কারণে ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণ তথ্যের গোপনীয়তা সম্পর্কে যথেষ্ট উদ্বেগ বাড়িয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বিরোধীদের দমন করতে ডেটা গভর্ন্যান্সের নামে সরকার নজরদারি চালাতে পারে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, তথ্য গোপনীয়তার উদ্দেশ্যে DPA তৈরি করা হলেও এর কিন্তু সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। এই অস্পষ্টতা ব্যবসায়িক জটিলতা তৈরি করতে পারে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর ফলে কমবে বিদেশি বিনিয়োগ। প্রস্তাবিত এ আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী সরকারের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে ভোক্তার তথ্য স্থানান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা পরিষ্কার যে, ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটা একটি মস্তবড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল DPA-কে একটি বিপজ্জনক বিল বলে মন্তব্য করেছে। সংস্থাটির মতে, এই বিল আইনে পরিণত হলে এটা হবে সরকারের সমালোচকদের স্তব্ধ করার একটি হাতিয়ার। জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়ে মাউথ মনে করেন, বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল বিশ্বায়নের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঠিক তখনই ডিপিএ’র বর্তমান খসড়ার কঠিন বিধিনিষেধ এবং ধারণাগত অস্পষ্টতা দেশের বাণিজ্য, চাকরি ক্ষেত্রেও এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট ছাড়াও ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফরমস’ এবং ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা’ নিয়েও নানা ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল আইনই এখন স্বাধীন সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বলে রাখা দরকার, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। এর আগে-পরে সাংবাদিক, আইনজীবী, নাগরিক সমাজ এ আইন নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল। কোনো কোনো আইনবিদ বলে থাকেন, অপপ্রয়োগ নয়, এ আইনের প্রয়োগই মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং হয়রানি। এ আইনে জামিনকে অত্যন্ত কঠিন করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগেই আসামিদের দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক থাকতে হচ্ছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক রিপোর্টে প্রথম চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১ হাজার ১০৯টি মামলার তথ্য পাওয়া যায়। এসব মামলায় অভিযুক্ত ২ হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে অন্তত ৩০১ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ২৮০ জন। মামলার একটি বড় অংশ শাসক দলের নেতাদের অবমাননার অভিযোগে করা।
ডিজিটাল আইনি বেড়াজালের মধ্যেই ঢাকার মিডিয়া নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে। বেড়েছে সেল্ফ সেন্সরশিপ। রিপোর্টাররা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কী লিখবেন আর কী লিখবেন না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট এতে আড়ালে থেকে যাচ্ছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও বহু রিপোর্টের মৃত্যু হচ্ছে। জেলা শহর কিংবা থানা এলাকাগুলো থেকে রিপোর্ট আসছে না বললেই চলে।
একটি স্বচ্ছ আর গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য মুক্ত মিডিয়া অপরিহার্য। এটা শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে সাহায্যই করে থাকে। বাংলাদেশেও মুক্ত এবং কর্মচঞ্চল মিডিয়া ফেরাতে হবে। এর জন্য সর্বপ্রথম আইনি খড়গ থেকে প্রয়োজন মুক্তি।
মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com