ডেস্ক রির্পোট:-রাজধানীসহ সারা দেশে গত ৩ বছর ২ মাস ৭ দিনে ছোট-বড় ৩৪৪টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩৬ জন। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিস্ফোরক আইন না মানার প্রবণতা এবং দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণে নিয়ম অনুসরণ না করায় বারবার এমন ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দায়িত্বে অবহেলা ও উদাসীনতা রয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বারবার এমন বিস্ফোরণকে জীবনের অধিকারের প্রতি হুমকি বলে মনে করছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩৪টি এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত ১০টি ছোট বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৩৬ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক। আহতদের মধ্যে অনেকে প্রাণে বেঁচে থাকলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে।
বিস্ফোরণের প্রতিটি ঘটনায় যথাযথভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত খান। তিনি বলেন, বাসা বাড়ি কারখানা গোডাউন এবং দাহ্য পদার্থ রাখা স্থানের বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে। কারখানা ও সরকারি সংস্থাগুলোতেও দক্ষ জনবল থাকতে হবে।
তিনি বলেন, রাসায়নিক শিল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এটা শিল্প ও মানুষের জীবনের জন্য ঝুঁকি।
২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যুর এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই সীতাকুণ্ডে গত ৪ মার্চ অক্সিজেন-গ্যাস উৎপাদন কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হন ৬ জন। অভিযোগ রয়েছে, কারখানার নিরাপত্তা ও কর্তৃপক্ষের সচেতনতা নিয়ে। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের গাফিলতি ছিল বলে মনে করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি। সীতাকুণ্ডে গত বছরের ওই ঘটনার পরও ওই এলাকার কারখানার চিত্র বদলায়নি।
প্রতিদিনই দেশের অফিস আদালত, বাসা বাড়ি, ছোট বড় কারখানা, শপিং মল, মার্কেট, কেমিক্যাল গোডাউন ও গ্যারেজে কোথাও না কোথাও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গ্যাস লাইন, কারখানার বয়লার, গ্যাস সিলিন্ডার, এসির কম্প্রেসারের ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ঘটছে। এ ছাড়া যেখানে সেখানে দাহ্য পদার্থ রাখা, বৈদ্যুতিক জিনিস পত্রের ত্রুটি নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক না করার কারণে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটছে।
গত তিন বছরে যেসব বিস্ফোরণ ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ইমামসহ ৩১ জনের মৃত্যু। ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয় এবং ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। এমন মৃত্যু ও ভয়াবহতা মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সকল ঘটনায় জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর পৃথক কমিটি গঠন করে প্রতিবারই কিছু বিষয় সুপারিশ করেছে, তবে কোনো সুপারিশ কেউ মানছে না। এমনকি মামলা হলেও অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা যায় না অদৃশ্য কারণে। বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। মামলার আট আসামির মধ্যে কেউ গ্রেপ্তার হননি। তাঁরা এখন জামিনে রয়েছেন। মামলার অগ্রগতি বলতে থানা-পুলিশ থেকে তদন্তের দায়িত্ব গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে স্থানান্তর করা হয়েছে। চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনে ২০১৯ সালে বিস্ফোরণের পর ৭১ জন মারা যান। এই ঘটনায়ও চকবাজার থানায় একটি মামলা হলেও বাড়ির মালিকসহ কাউকেই বিচারের আওতায় আনা যায়নি। ঘটনার পর তাঁদের গ্রেপ্তারও করা হয়নি। জামিনে আছেন বর্তমানে।
মামলার তদন্তে ধীর গতির বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের ব্যাপ্তি বড়। তাই সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে প্রতিটি ঘটনাই তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিস অভিযোগ করেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মালিক ও সাধারণ মানুষের ধারাবাহিক গাফিলতির কারণে এ বছরেও একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে। সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান, পরিদর্শকদের সচেতন হতে হবে, পাশাপাশি জনগণকেও বুঝতে হবে তার গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
২০২০ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩৪টি বিস্ফোরণের পর এ বছরের প্রথম ২ মাস ৭ দিনে ১০টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত ৪ মার্চ সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন কারখানায় আগুনে ছয়জন নিহত হন। একই দিন ভোরে রাজধানীর গুলশানে এসি বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু হয় এবং ৫ মার্চ আবার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণে একই প্রতিষ্ঠানের তিনজন কর্মী মারা যান।
এদিকে সায়েন্স ল্যাবের শিরিন ম্যানশনের বিস্ফোরণে তিনজন নিহতের ঘটনার পরপরই গুলিস্তানে সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ। এই ঘটনায় ৮ মার্চ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং অন্তত ১২০ জন আহত হয়েছেন।
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) এর বোম ডিস্পোজাল টিম দুটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সংস্থাটির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ও সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয় দলের প্রধান রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, সায়েন্স ল্যাবের বিস্ফোরণ ও গুলিস্তানের বিস্ফোরণের ধরন একই। আবার এই দুটির সঙ্গে ২০২১ সালের মগবাজারের বিস্ফোরণেরও মিল রয়েছে। ভবনটিতে কোনো না কোনোভাবে গ্যাস জমে ছিল।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্রমাগতভাবে বিস্ফোরণকে জীবনের অধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে আখ্যা দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা প্রকৃত দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু, তার সঠিক তদন্ত প্রয়োজন।
কী কারণে এমন বিস্ফোরণ, কেন এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো, সেটার সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ঢাকার সায়েন্স ল্যাব, এখন সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনাগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কিনা, সেটাও গোয়েন্দাদের দেখতে হবে। আজকের পত্রিকা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com