ডেস্ক রির্পোট:- মানুষের হৃৎপিণ্ডের ভেতরে রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য চারটি ভাল্ভ থাকে। কোনো কারণে এসব ভাল্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে হৃৎপিণ্ড ঠিক রাখতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা প্রতিস্থাপন করতে হয়। কৃত্রিম এসব ভাল্ভ মাত্র ১৫ দিন আগেও কোম্পানিভেদে ৫২ থেকে ৫৮ হাজার টাকায় পাওয়া যেত। এখন সেগুলোর দাম হয়েছে ৯৮ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। অর্থাৎ দাম বেড়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ। ভাল্ভ প্রতিস্থাপনের জন্য একটি অক্সিজেনেটর কিটের প্রয়োজন হয়। এই ডিভাইসটির দাম আগে ছিল ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
শুধু ভাল্ভ ও অক্সিজেনেটর কিট নয়, ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে হৃদ্রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি মেডিকেল ডিভাইসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তবে যে হারে দাম বাড়ানো হয়েছে, তা অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ডলারের সংকটের প্রভাবে আমদানির ক্ষেত্রে সামগ্রিক ব্যয় বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। কিন্তু দাম বাড়ানো হয়েছে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ।
ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় স্ট্যান্ট বা রিং। রোগীর প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন দাম ও মানের রিং রয়েছে বাজারে। প্রতিটিরই দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আগে যে রিং ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় পাওয়া যেত, বর্তমানে সেগুলোর দাম হয়েছে ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টাকা। ৭২ থেকে ৭৫ হাজার টাকার রিংয়ের দাম বেড়ে হয়েছে ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। যেসব রিং কদিন আগেও ১ লাখ ৪৭ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যেত, এখন সেগুলোর দাম বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। যে রিংগুলোর দাম ১ লাখ ৮ হাজার থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকার মধ্যে ছিল, সেগুলোর দাম বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
হৃদ্রোগের চিকিৎসায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস হলো পেসমেকার। ইলেক্টোফিজিওলজির সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করতে পেসমেকার ব্যবহার করা হয়। সিঙ্গেল চেম্বার পেসমেকারের দাম ছিল ১ লাখ টাকা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আর ডুয়েল চেম্বার পেসমেকারের দাম ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
আমদানিকারকের ইচ্ছায় দাম পুনর্নির্ধারণ দাম নির্ধারণের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করেছিল ‘অ্যাডভান্স মেডিটেক’ নামের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ ডিসেম্বর তাদের আমদানি করা ৬টি পণ্যের দাম পুনর্নির্ধারণ করে অধিদপ্তর। সেখানে দেখা গেছে, সিঅ্যান্ডএফ খরচসহ যে রিংয়ের দাম ৫৩১ ডলার, তার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। অথচ ডলারের বর্তমান বিনিময়মূল্য ১০৬ টাকা ধরলে সেই রিংয়ের দাম হয় ৫৬ হাজার ২৮৬ টাকা। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ মুনাফা যুক্ত হলে দাম ৬৪ হাজার ৭২৮ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু পুনর্নির্ধারণের নামে অস্বাভাবিক দাম ধার্য করার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়নি অধিদপ্তর।
কার্ডিয়াক মেডিকেল ডিভাইসের মান, নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয়তা এবং কার্যকারিতার মূল্যায়ন এবং মূল্যসংক্রান্ত বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৬ জুন। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তখনকার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আফজালুর রহমানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের এই কমিটি গঠিত হয়। পরে এই কমিটি কার্ডিয়াক মেডিকেল ডিভাইসের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে।
কিন্তু সম্প্রতি দাম বাড়ার ক্ষেত্রে এই উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। এমনকি তাদের কোনো মতামত পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরবরাহকারীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছে অধিদপ্তর।
দেশে বর্তমানে ৪২টি প্রতিষ্ঠান কার্ডিয়াক মেডিকেল ডিভাইস সরবরাহ করে থাকে। কার্ডিয়াক মেডিকেল ডিভাইসের দাম পুনর্নির্ধারণে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এসব প্রতিষ্ঠানের মতামতকেই গুরুত্ব দিয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞদের।
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আফজালুর রহমান বলেন, একটা সময় কার্ডিয়াক মেডিকেল ডিভাইসের দাম অনেক বেশি ছিল। আমদানিকারকেরা ইচ্ছেমতো দাম রাখত। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই কমিটি ডিভাইসগুলোর যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দেয়, যা সাধারণ মানুষের জন্য সহনীয় পর্যায়ে আসে। কিন্তু এবার বর্তমানে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন কমিটির সঙ্গে আলোচনা করেনি। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয়ও করা হয়নি। তিনি মনে করেন, পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে ডিভাইসের দাম আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।
ওই উপদেষ্টা কমিটিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত ছিলেন জাতীয় হৃদ্রোগ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জুলফিকার আলী লেলিন। তিনি বলেন, ‘নতুন করে ডিভাইসের দাম বাড়ার হার যুক্তিসংগত মনে হয়নি। এটা অনেক বেশি বলে মনে হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে ডিভাইসের দাম বাড়ানো হলেও বাড়ার হার অত্যন্ত বেশি। দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে আমরা কাজ করছি।’
এ প্রসঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন বলেন, ডলারের সংকট ও এলসি জটিলতায় আমদানিকারকেরা দাম বাড়ানোর আবেদন করেন। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এটাকে ঠিক দাম বাড়ানো বলা যাবে না। তাই এই দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।আজকের পত্রিকা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com