ডেস্ক রির্পোট:- ভারতের গুজরাটে পাচার হওয়া বাংলাদেশি এক তরুণীর খুনের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গুজরাটের বারুচ এলাকায় নৃশংসভাবে খুনের শিকার ওই তরুণীর শেলী আক্তার (ছদ্মনাম)। দেড় বছর আগে তিনি পাচারের শিকার হয়েছিলেন। সব শেষ বারুচের ‘এনজেল স্পা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে শেলী (১৯) কাজ করতেন। ঘটনার পর থেকেই ওই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে বলে সেখানকার পুলিশ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছে। এদিকে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় বসবাসকারী নিহতের পরিবারের সদস্যদের ধারণা, এক বছর আগে বাংলাদেশি এক তরুণীর খুনের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে ফেলেছিলেন শেলী। সম্প্রতি সেই বিষয়টি জানাজানি হওয়ার কারণেই হয়তো শেলী খুন হয়েছেন।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এখনো বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হইনি। তবে অবগত হলে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চটা করব। অতীতেও র্যাব মানব পাচার নিয়ে অনেক সফল অভিযান সম্পন্ন করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯ মাস আগে ছয় মাসের শিশুসন্তানকে ফেলে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান শেলী। তিন দিন পর বাবাকে জানান, তিনি দুবাইয়ে আছেন। তার মতো আরও অনেক বাংলাদেশি তরুণী সেখানে আছেন। জীবন বাঁচানোর জন্যই তিনি ঘর ছেড়েছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি হতদরিদ্র রিকশাচালক বাবা জীবন মিয়া (ছদ্মনাম) ও মা রাহেলা বেগমকে (ছদ্মনাম) ফোন দিতেন। প্রতি মাসে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা পাঠাতেন শেলী। ডেমরার হাজীনগরের অটোরিকশাচালক রমজানের (লোলা রমজান) বোনের মাধ্যমে তিনি বিদেশে গেছেন। ১৯ জানুয়ারি একটি বিদেশি নম্বর থেকে কল আসে শেলীর বাবার কাছে। অপর প্রান্ত থেকে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলা হলে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না জীবন মিয়া। পরে নিকটবর্তী রফিকুল ইসলামের শরণাপন্ন হন তিনি। রফিকুল নিশ্চিত হন, অপর প্রান্তের ব্যক্তি গুজরাট বি-ডিভিশন বারুচ পুলিশস্টেশনের ইন্সপেক্টর শুভেন্দু পাটেল। সেই পুলিশ কর্মকর্তাই জানান, বারুচের একটি জায়গা থেকে শেলীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে ফাঁস দিয়ে খুন করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি সেলফোন, টুম্পা পারভেজ শেখ নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র এবং আধার কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। পরে সেই কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
ইন্সপেক্টর শুভেন্দু পাটেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মোবাইল ফোনে থাকা সবগুলো নম্বরই আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। একটি বাংলাদেশি নম্বরে কল করে শেলীর পরিচয় আমরা জানতে পেরেছি। তাদের লাশ নেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতে বলেছি। নইলে আমরা এখানে সমাহিত করব।’
আরেকটি খুনের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন শেলী। সেই কারণেই খুন হয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে ইন্সপেক্টর শুভেন্দু বলেন, স্থানীয় ‘এনজেল স্পা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন শেলী। ঘটনার পর থেকেই সেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ। তবে মুম্বাই পুলিশও খুনের ঘটনাটি নিয়ে কাজ করছে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের মে মাসে ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নারী পাচারের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। ওই ঘটনায় ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়সহ ভারতের পুলিশ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। পরে পুলিশ ও র্যাব নারী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি চক্রের ১২ জনকে গ্রেফতার করে। তখন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, শুধু এই দুই চক্র পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার নারীকে ভারতে পাচার করেছে। পুলিশ সদর দফতরের বরাত দিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি জানায়, ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাচারের ঘটনায় দেশে ও দেশের বাইরে ৬ হাজার ৭৩৫টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে ভুক্তভোগীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১২ হাজার ৩২৪। গত ১২ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার ৫০ জনকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৫১ জনকে ফিরিয়ে এনেছে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। ২০২২ সালে এদের ৪৭ জন এবং আজ (বৃহস্পতিবার) হায়দরাবাদ থেকে পাচার হওয়া তিনজন নারীকে দেশে এনেছে সংস্থাটি। এদিকে শেলী খুনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও ‘এডসেক’-এর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা আলীর কাছে। তিনি বলেন, ‘গুজরাট জায়গাটা এমনিতেই খুব ভয়ংকর। মাঝেমধ্যেই সেখানে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে। আমার মনে হচ্ছে শেলীর বিষয়টির সঙ্গে অনেকেই জড়িত। কাদের মাধ্যমে তিনি পাচারের শিকার হয়েছেন, কারা খুনের সঙ্গে জড়িত এসব বিষয়ে দুই দেশের পক্ষ থেকেই তদন্ত করা দরকার। পাচার চক্রের মূলোৎপাটন করতে দুই দেশের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়ানো দরকার। অনুসন্ধান আরও বলছে, ২০২০ সালে স্থানীয় জয় মোহাম্মদ নামের এক যুবককে ভালোবেসে বিয়ে করেন শেলী। জয় ডেমরা থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। বিয়ের তিন-চার মাস পরই জয়-শেলীর সংসারে নেমে আসে অশান্তির ঝড়। প্রতিদিনই মাদকাসক্ত জয় মারধর করতেন শেলীকে। এক বছরের মাথায় মেয়েসন্তান ভূমিষ্ঠের পর শেলীর ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সন্তান মেয়ে হওয়ার কারণে জয় দুই মাস তার মুখই দেখেননি বলে জানিয়েছেন শেলীর পরিবারের সদস্যরা। খেয়ে না খেয়েই কাটছিল শেলী ও তার মেয়ের জীবন। বাবা ও এক ফুফু মাঝেমধ্যেই খাদ্য কিনে দিয়ে আসতেন শেলীকে। রিকশাচালক দরিদ্র বাবার পক্ষে সব সময় শেলীর খোঁজ নেওয়া সম্ভব হতো না। ২০২১ সালের জুন মাসে ছয় মাস বয়সী মেয়েকে ফুফুর কাছে রেখে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান শেলী। শেলীর পরিবারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বলেন, এক বছর আগে শেলী তার সঙ্গেই থাকা আরেক নারীর খুনের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেছিলেন। সেই দৃশ্য তার বাবার মোবাইলেও পাঠিয়েছিলেন শেলী। তখন শেলী বলেছিলেন, খুন হওয়া ওই মেয়েটির বাড়ি বাংলাদেশের কুমিল্লায়। ওই ঘটনার পর থেকে শেলী নিজেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তিনি বাবাকে কোনো এক সময় জানিয়েছিলেন, তাকে ৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
শেলীর পরিবারের ওই সদস্য বলেন, ভারতে শেলীর সঙ্গে থাকা আরেকটি মেয়ের নাম বৃষ্টি। তার বাড়ি খুলনায়। শেলী এক বছর আগে তার বাবার জন্য একটি মোবাইল ফোন পাঠিয়েছিলেন বৃষ্টির মায়ের মাধ্যমে।
নিহত শেলীর স্বামী জয় মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সব সংসারেই তো কিছু সমস্যা থাকে। আমি একটি মাদক মামলায় ২৪ দিন জেল খেটে বের হওয়ার কয়েক দিন পরই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। তবে এটা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। এর পরও শেলীর সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যেই কথা হতো।’
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com